যদ্যপি আমার গুরু আহমদ ছফার রচিত একটি স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ।এই দীর্ঘ স্মৃতিচারণামূলক রচনাটি ১৯৯৮ সালে বই আকারে প্রকাশের আগে দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকার সাহিত্য পাতায় প্রায় চার মাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সাথে ছফার বিভিন্ন বিষয়ে কথোপকথনসমূহের বিবরণ পাওয়া যায় এই গ্রন্থে। এই ব্লগে আহমদ ছফার যদ্যপি আমার গুরু বইয়ের বিখ্যাত বিখ্যাত লাইন ও অসাধারণ কথা থাকছে এই ব্লগে।
১#
পড়ার কাজটি অইল অন্যরকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোনো বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কিনা। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনের শব্দভান্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইর্যা নিবেন , আপনের পড়া অয় নাই।
২#
জ্ঞান-বিজ্ঞান ব্যক্তির সাধনায় বিকশিত হয়, কিন্তু সমাজের মধ্যে জ্ঞানের প্রয়োজন অনুভূত হওয়া চাই। বৃহত্তর অর্থে জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনাও বৃহত্তর সমাজ প্রতিক্রিয়ার একটি অংশ।
৩#
বইয়ের দোকান পরখ করলেই বেবাক সমাজটা কোনদিকে যাইতাছে, হেইডা টের পাওন যায়
৪#
ক্ষেত চাষবার সময় জমির আইল বাইন্দা রাখতে হয় (বই পড়ার সময় টুকে রাখার অভ্যাস)।
৫#
যে ধরনের কাজে অমানুষিক মানসিক শ্রমের প্রয়ােজন হয়, সে ধরনের কাজ করার প্রেরণা আমাদের সমাজ থেকে সংগ্রহ করা একরকম অসম্ভব। এখানে একজন বড় কাজ করলে উৎসাহ দেয়ার জন্য কেউ এগিয়ে আসে না।
৬#
যে জাতি যত মিডিলাইজড তার রান্নাবান্নাও তত বেশি সফিস্টিক্যাডেড।
৭#
রবীন্দ্রনাথ বড় লেখক, মানুষ হিসাবে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগর কিংবা তার মত মানুষদের ধারে কাছে বসতে পারেন না, বড় লেখক ও বড় মানুষ এক নয়। বড় লেখক এর মধ্যে বড় মানুষের ছায়া থাকে। আর বড় মানুষ আসলেই বড় মানুষ।
৮#
১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত শেখ সাহেব যারেই স্পর্শ করছে তার মধ্যে আগুন জালাইয়া দিছে।
৯#
লেখার ব্যাপারটি হলো পুকুরে ঢিল ছোড়ার মত। যত বড় ঢিল যত জোরে ছুড়বেন পাঠকের মনে তরঙ্গ টা তত জোরে উঠবে। আর পড়ার কাজটি হইল অন্যরকম -কোন বই পইড়া নিজেরে জিগাইবেন নিজের ভাষায় বইটা লিখতে পারবেন কিনা।
১০#
তরুণ বয়সে মানুষের শরীরে কোন অংশে চোট লাগলে যৌবনে সে অনুভব করা যায় না অনেক সময়। বুড়ো হলে ব্যথাটা ফিরে আসে।
১১#
আমাদের শ্রদ্ধাভাজন বয়ােজ্যেষ্ঠরা যেভাবে আমাদের উপকার করতে চান আমরা পরবর্তী প্রজন্মের তরুণরা যেভাবে উপকৃত হতে চাই, তার মধ্যে বিস্তর ফারাক, সেদিন খুব ভালােভাবে বুঝতে পেরেছিলাম।
১২#
দ্যাহেন বাংলাদেশ সরকার জসীমউদ্দীনকে কিছু করলো না আমারে আর জয়নুল আবেদীন সাহেবরে মুশকিলে ফেলাইয়া দিছে। আমাগো দুজনেরে ন্যাশনাল প্রফেসর বানাইছে, আর জসিম উদ্দিনকে কিছুই বানায় নাই।
১৩#
ইসলাম ধর্মের সাথে অন্যান্য ধর্মের একটা বড় পার্থক্য এইখানে যে ইসলাম ধর্মেও পরকালের গুরুত্ব স্বীকার করা হইছে। কিন্তু ইহকালের গুরুত্ব অস্বীকার করা হয় না।
১৪#
বঙ্কিমের চিন্তা আধুনিক কিন্তু বিষয়বস্তু ধর্মীয়।
১৫#
সৃষ্টিশীল মানুষেরা সাধারণত বিপজ্জনক ধরনের হয়ে থাকেন। বাইরে তারা যতোই নিরীহ এবং অপরের প্রতি মনোযোগী হয়ে থাকুন না কেনো ভেতরে তাদের স্বেচ্ছাচারী হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। যেখানে আত্মপ্রকাশের বিষয়টি অপর সকল কিছুকে ছাপিয়ে ওঠে, সেখানে ব্যক্তিকে অনিবাৰ্যভাবে স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে হয়। সৃষ্টিধর্মের নিয়ম ছাড়া বাইরের কোনো নিয়ম সেখানে ক্রিয়াশীল হয়ে উঠতে পারে না।
১৬#
যখন কোন নতুন জায়গায় যাইবেন পয়লা দুইটা জিনিস জানার চেষ্টা করবেন, ওই জায়গার মানুষ কি খায় আর পড়ালেখা কি করে। কী পরে আর কী খায় এই দুইটা জিনিস না জানলে একটা জাতির কোন কিছু জানন যায় না।
১৭#
রেনেসাঁর আগে পরকালটাই আছিল সব আর রেনেসাঁর পরে এই দুনিয়াটাই সব পরকাল কিছুই না।
১৮#
আমরা শিক্ষকেরা প্রতিবছর বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু প্রতিটি নতুন বছরে আমাদের কাছে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এসে হাজির হয়। এই তরুণদের চাহিদা, চাওয়া পাওয়ার খবর আমাদের মত লোলচর্মের বৃদ্ধদের জানার কথা নয়। এটাই হলো শিক্ষাজীবনের বড় ট্র্যাজেডি।
১৯#
যদ্যপি আমার গুরু শুড়িবাড়ি যায়,
তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।
২০#
শেকসপীয়র বলেছেন, ফ্যামিলিয়ারিটি ব্রীডস কনটেম্পট – অতিপরিচয়ে সুন্দর সম্পর্কও মলিন হয়ে যায় । প্রত্যহের পরুষ স্পর্শে অত্যন্ত হার্দ্য সম্পর্কের মধ্যেও ময়লা জমতে থাকে ।
২১#
প্রথমে লাইব্রেরিতে ঢুইক্যাই আপনার টপিকের কাছাকাছি যে বই পাওন যায় পয়লা একচোটে পইড়া ফেলাইবেন। তারপর একটা সময় আইব আপনে নিজেই খুঁইজা পাইবেন আপনার আগাইবার পথ।
২২#
মাতৃস্তনে শিশুর যেরকম অধিকার শিক্ষকদের স্নেহের উপর ছাত্রদের তেমন অধিকার থাকা উচিত।
২৩#
সব সময় লেবু দিয়া চা খাইবেন, চায়ে যে দোষ আছে ব্যাবাক এক্কেবারে কাইটা যাইবো।
২৪#
মানুষের মন ভারি বিদঘুটে জিনিস। কত অসম্ভব বস্তুর কল্পনা করে।
২৫#
মার্কসের হিসাবমতো গ্রেট ব্রিটেন কিংবা শিল্পসমৃদ্ধ জার্মানিতেই বিপ্লব হওয়ার কথা। মার্কসীয় থিসিস অনুসারে রাশিয়াতে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লব কিছুতেই সম্ভব নয়। লেনিন মার্কসীয় চিন্তা-পদ্ধতিতে একটু অদলবদল ঘটিয়ে রাশিয়াতে শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে একটা বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্যই রাশিয়ার অর্থনৈতিক ইতিহাসটি লিখেছিলেন।