মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯ মে, ১৯০৮ – ৩ ডিসেম্বর, ১৯৫৬) ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তার প্রকৃত নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী জুড়ে মানবিক মূল্যবোধের চরম সংকটময় মুহূর্তে বাংলা কথা-সাহিত্যে যে কয়েকজন লেখকের হাতে সাহিত্যজগৎে নতুন এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। তার রচনার মূল বিষয়বস্তু ছিল মধ্যবিত্ত সমাজের কৃত্রিমতা, শ্রমজীবী মানুষের সংগ্রাম, নিয়তিবাদ ইত্যাদি।
ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ ও মার্কসীয় শ্রেণীসংগ্রাম তত্ত্ব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যা তার রচনায় ফুটে উঠেছে। জীবনের অতি ক্ষুদ্র পরিসরে তিনি রচনা করেন চল্লিশটি উপন্যাস ও তিনশত ছোটোগল্প। তার রচিত পুতুলনাচের ইতিকথা, দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মা নদীর মাঝি ইত্যাদি উপন্যাস ও অতসীমামী, প্রাগৈতিহাসিক, ছোটবকুলপুরের যাত্রী ইত্যাদি গল্পসংকলন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ বলে বিবেচিত হয়। ইংরেজি ছাড়াও তার রচনাসমূহ বহু বিদেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর, মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শক্তিশালী এই কথাসাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে।
১#
অন্ধকারে যে বাস করে মৃদু আলোতে তাহার চোখ ঝলসাইয়া যায়।
(পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাস থেকে)
২#
কেহ বিশ্বাস করে, কেহ করে না। যে বিশ্বাস করে সেও সত্য-মিথ্যা যাচাই করে না, যে অবিশ্বাস করে সেও না। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নটা নির্ভর করে মানুষের খুশির উপর।
(পুতুল নাচের ইতিকথা)
৩#
মেয়েমানুষের এরকম হয়, ওরকম হয়, সব রকম হয়, শুধু মনের মত হয় না।
(পুতুলনাচের ইতিকথা)
৪#
মনে পাপ থাকার এই একটা লক্ষণ। মনে হয়, সকলে বুঝি সব জানে।
(পুতুলনাচের ইতিকথা)
৫#
মিথ্যারও মহত্ত্ব আছে। হাজার হাজার মানুষকে পাগল করিয়া দিতে পারে মিথ্যার মোহ। চিরকালের জন্যে সত্য হইয়াও থাকিতে পারে মিথ্যা।
(পুতুলনাচের ইতিকথা)
৬#
বয়স্ক উপযুক্ত সন্তানকে বশ করা, জগতে এতবড় জয় আর নাই।
(পুতুলনাচের ইতিকথা)
৭#
বাড়ি ফিরিয়া শশী বুঝিতে পারে কল্পনার এমন কতগুলি স্তর আছে, বিশেষ কোন উপলক্ষ ছাড়া যেখানে উঠিবার ক্ষমতা মানুষের নাই। এক একটা ঘটোনা যেন চাবির মত মনের এক একটা দুয়ার খুলিয়া দেয়, যে দুয়ার ছিল বলিয়াও মানুষ জানিত না।
৮#
অন্ধকারে যে বাস করে মৃদু আলোতে তাহার চোখ ঝলসাইয়া যায়, চোখ ঝলসানো আলোতে সে হয় অন্ধ।
৯#
সেই যে গেল গোপাল আর ফিরিল না । সংসারী গৃহস্থ মানুষ সে, সমস্ত জীবন ধরিয়া ফলপুষ্পশস্যদাত্রী ভূমিখণ্ড, সিন্দুক ভরা সোনারূপা, কতকগুলি মানুষের সঙ্গে পারিবারিক ও আরো কতকগুলি মানুষের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক, দায়িত্ব, বাধ্যবাধকতা প্রভৃতি যত কিছু অর্জন করিয়াছিল সব সে দিয়া গেল শশীকে, মরিয়া গেলে যেমন সে দিত ।
১০#
খুঁজিলে এমন কিছুও পাওয়া যায় জগতে বাঁচিয়া থাকার চেয়ে যা বড়।
১১#
শশীর চোখ খুঁজিয়া বেড়ায় মানুষ । যারা আছে তাদের, আর যারা ছিল ।
১২#
জীবনকে জানা আর জীবনকে মায়া করা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে । একটাকে বড় করে অন্যটাকে তুচ্ছ করা জীবনদর্শীর পক্ষে বীভৎস অপরাধ
১৩#
রাগ, প্রতিহিংসা এসব মানুষের অবলম্বন, সহজে ওসব ছাড়িতে চায়না।
১৪#
মৃত্যুতে মানুষের লজ্জা নেই, কারণ মৃত্যু যবনিকা নয়, পটপরিবর্তন। নিজের জীবন মানুষ পৃথিবীর মানুষের মধ্যে জমা করে রেখে যায়, স্বর্গে নিয়ে যায় না।
জমা করা জীবন যখন পঁচে যায়? একমাত্র নোয়া-কে বাঁচিয়ে প্রলয়য়ের মধ্য দিয়ে যখন ভগবান ভ্রম সংশোধন করতে বাধ্য হন?
তখন ভগবান অত্যাচারী খেয়ালি। প্রলয় যে এনে দিতে পারে সে সংস্কারে অক্ষম হবে কেন? জীবনের রোগ আছে, ফাঁসি ছাড়া আরোগ্য নেই? ক্রমাগত রোগে ভোগার চেয়ে মরণ ভালো, কিন্তু রোগ সারিয়ে বেঁচে থাকা আরো ভালো।
১৫#
সাহিত্য বাদ দিয়ে বৈজ্ঞানিক হলে, তিনি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হিংস্র মানুষের হাতে মারণাস্ত্রই তুলে দেবেন- তাঁর আবিষ্কারকে মানুষ মানুষকে ধ্বংশ করার কাজে ব্যবহার করবে।
১৬#
প্রতিভা হল দক্ষতা অর্জনের বিশেষ ক্ষমতা ।
১৭#
বাংলা পেশাদার সাহিত্যিকের অবস্থাটা কি দাঁড়ায়? আগেই বলেছি সাময়িকপত্রের দক্ষিণা সমান্য। টাকার জন্য তাই অনেকগুলি কাগজে তাকে লিখতে হবে। বই বিক্রি হয় কম – সুতরাং বেশি বইও তাকে লিখতে হবে।
দু’দিক দিয়ে তার ফল হবে মারাত্মক।
নাম আছে সুতরাং কাগজের মালিকের কথা না ভাবলেও চলে – কিন্তু ওই যে পাঁচখানা কাগজের পাঁচরকম রুচির পাঠক পাঠিকা, তাদের রুচির কথা না ভাবলে তো চলবে না! পাঁচ রকমের পাঁচমিশেলী লেখার খিচুড়ি সাহিত্যে বোঝাই পত্রিকাটির বিক্রির মধ্যে যে বাস্তব সত্যের প্রকাশ তাতে খাতির না করলে অর্থাৎ বেশি সংখ্যক লোকের কাছে রুচিকর হয়, খানিকটা এই ধরণের বই না লিখলে তো চলবে না!
ব্যস, খতম হয়ে গেল লেখকের স্বাধীন সৃষ্টির স্বাধীনতা!
এই গেল ক্রেতা বাড়াবার জন্য নিজের চেতনা ও প্রতিভার যোগ্য ব্যবহার ছাঁটাই করার দিক! অন্য দিকটা হলো বেশি বেশি লিখতে বাধ্য হওয়ার দিক।
হলেন বা নাম-করা লেখক, নতুন চিন্তা আর অভিজ্ঞতার কতই বা তার পুঁজি! পুঁজি খরচ করে বই লিখে তবেই তো নাম-করা লেখক হয়েছেন! পুঁজি ফুরিয়ে গেলে উপায়? পুঁজি বাড়াবার উপায় নেই, বেশি লিখে নতুন চিন্তা ও অভিজ্ঞতার পুঁজি সঞ্চয় করার সময় কই!
অগত্যা বলা কথাই আবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নতুনভাবে বলার চেষ্টা।
ব্যস, খতম হয়ে গেল সাহিত্য সাধনা।
১৮#
জীবনকে শ্রদ্ধা না করিলে জীবন আনন্দ দেয় না।শ্রদ্ধার সঙ্গে আনন্দের বিনিময়,জীবনদেবতার এই রীতি।
১৯#
নদীর মত নিজের খুশিতে গড়া পথে কি মানুষের জীবনের স্রোত বহিতে পারে? মানুষের হাতে কাটা খালে তার গতি, এক অজানা শক্তির অনিবার্য ইঙ্গিতে। মাধ্যাকর্ষণের মত যা চিরন্তন অপরিবর্তনীয়।
২০#
জানিবার এত বিষয়, উপভোগ করিবার এত উপায়, বিজ্ঞান ও কাব্য মিশিয়া এমন জটিল, এমন রসালো মানুষের জীবন ?
২১#
…সবাই নিজেকে ভোলায়। খিদে-তেষ্টা পেলে তা মেটানো, ঘুম পেলে ঘুমানো, এসব ছাড়া জীবনটা আমাদের বানানো, নিজেকে ভোলানোর জন্য ছাড়া বানানোর কষ্ট কে স্বীকার করে? বেশিরভাগ মানুষের এটা বুঝবার ক্ষমতা থাকে না, সারাজীবন ভুলও ভাঙে না, বুঝতেই যদি না পারা যায়, ভুল তবে আর কিসের ভুল? কেউ কেউ টের পেয়ে যায়, তাদের হয় কষ্ট। জীবনকে যারা বুঝে, বিশ্লেষণ করে বাঁচতে চায় এই জন্য তারা বড় দুঃখী। বড় যা কিছু আঁকড়ে ধরতে পায় তাই ভুয়ো। এই জন্য এই ধরনের লোকের মনে জীবন থেকে বড় কিছু প্রত্যাশা থাকা বড় খারাপ- যত বড় প্রত্যাশা তত বড় দুঃখ পায়
২২#
সুখ? নাই-বা রইল সুখ! সুখ দিয়ে কি হবে? সুখ তো শুঁটকি মাছ! জিভকে ছোটলোক না করলে স্বাদ মেলে না।
২৩#
ছেলে বড় হইলে কি কঠিন হইয়া দাঁড়ায় তার সঙ্গে মেশা। সে বন্ধু নয়,খাতক নয়,উপরওয়ালা নয়,কি যে সম্পর্ক দাঁড়ায় বয়স্ক ছেলের সঙ্গে মানুষের,ভগবান জানেন।
২৪#
কী ক্ষতি মুসলমানের রান্না খাইলে? ডাঙার গ্রামে যারা মাটি ছানিয়া জীবিকা অর্জন করে তাহাদের ধর্মের পার্থক্য থাকে, পদ্মানদীর মাঝিরা সকলে একধর্মী।
২৫#
সব মানুষের মধ্যে একটি খোকা থাকে যে মনের কবিত্ব,মনের কল্পনা,মনের সৃষ্টিছাড়া অবাস্তবতা,মনের পাগলামিকে লইয়া সময়ে-অসময়ে এমনিভাবে খেলা করিতে ভালবাসে।
২৬#
ধর্ম যতই পৃথক হোক দিনযাপনের মধ্যে তাহাদের বিশেষ পার্থক্য নাই। সকলেই তাহারা সমভাবে ধর্মের চেয়ে এক বড় অধর্ম পালন করে- দারিদ্র্য!
২৭#
গ্রামের লোকের অনুমান শক্তি প্রখর। সকালে আকাশের দিকে চাহিয়া তাহারা বলিয়া দিতে পারে বিকালে বৃষ্টি হইবে। বিকালে যদি নেহাৎ বৃষ্টি না-ই হয় সে অপরাধ অবশ্য আকাশের।
২৮#
ঘুম তো মরে যাওয়ার সমান,শুধু সময় নষ্ট।
২৯#
স্পন্দিত বেদনা প্রাণ ও চেতনার একমাত্র পরিচয়।
৩০#
জীবনে বাহুল্যের প্রয়োজন আছে।কত বিচিত্র উপায়ে মানুষ এ প্রয়োজন মেটায়!
৩১#
দুঃখকে ভয় কোরো না, দুঃখ মানুষের দুর্লভতম সম্পদ।
৩২#
প্রেম একটা অস্থায়ী জোড়ালো নেশামাত্র।
৩৩#
তেজী আলোর চেয়ে জ্যোৎস্নার মতো মৃদু আলোতে মানুষের মুখ আরো বেশি সুন্দর হিয়ে ওঠে।
৩৪#
একমাসের বেশি হৃদয়ে প্রেমকে পুষে রাখতে হলে মানুষ মরে যাবে মানুষ একদিন কি দুদিন মাতাল হয়ে থাকতে পারে।জলের সঙ্গে মদের যে সম্পর্ক,মদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক তাই-প্রেম এত তেজী নেশা।
৩৫#
রোমিও জুলিয়েটের ট্রাজেডি তাদের মৃত্যুতে নয়।ওদের প্রেমের অসমাপ্তিতে!
৩৬#
প্রেম বেঁচে আছে তখন দুজনের একজন মরে গেলে শোক হয়-অক্ষয় শোক হয়।প্রেমের অকালমৃত্যু নেই বলে শোকের মধ্যে প্রেম চিরন্তন হয়ে যায়।কিন্তু প্রেম যখন মরে গেছে,তখন আছে শুধু মায়া,অভ্যাস আর আত্মসান্তনার খেলা,তখন যদি দুজনের একজন মরে যায়,বেশিদিন শোক হওয়া অসুস্থ মনের লক্ষণ।সেটা দুর্বলতা!
৩৭#
প্রেম অসহ্য প্রাণঘাতী যন্ত্রণার ব্যাপার।প্রেম চিরকাল টিকলে মানুষকে আর টিকতে হত না।
৩৮#
প্রেমিকের কাছে প্রেমের অগ্রগতির ইতিহাস নেই।যতদূরই এগিয়ে যাক সেইখান থেকেই আরম্ভ।আগে কিছু ছিল না ছিল অন্ধকারের সেই নিরন্ধ্র কুলায়,যেখানে নব জন্মলাভের প্রতীক্ষায় কঠিন আস্তরণের মধ্যে হৃদয় নিস্পন্দ হয়ে ছিল।
৩৯#
কুমারীর কাউকে প্রণাম করতে নেই।
৪০#
মেয়েরা মার চেয়ে পিতাকেই নকল করে বেশি,পিতার শিক্ষাই মেয়েদের জীবনে বেশি কার্যকরী হয়।
৪১#
মৃত্যু মুক্তি দেয় না যাহাকে
প্রেম তার মহামুক্তি।-নূতন শরীর
মুক্তি নয়,মুক্তির আভাষ।
৪২#
স্ত্রীকে যে ভালবাসে সে অপেক্ষা করে।
৪৩#
ভালবাসার বাড়া-কমা নেই।ভালবাসা ধৈর্য আর তিতিক্ষা।একটামা উগ্র অনুভূতি হল ভালবাসা।
৪৪#
নিজের ব্যবসার কথা বলতে পেলে সকলেই খুশি হয়।
৪৫#
শরীর ভাল রাখার চেয়ে বড় কাজ মানুষের নেই।শরীর ভালো না থাকলে মানুষ ভাবুক হয়,দুঃখ বেদনা কল্পনা করে,ভাবে জীবনটা শুধু ফাঁকি।বদহজম আর ভালবাসার লক্ষণগুলি একরকম!
৪৬#
হয়তো সত্য সত্যই মেয়েদের মঙ্গলের ব্যবস্থা করতে গিয়ে পুরুষেরা গোঁড়াতেই কোথাও একটা গলদ বাধিয়ে বসে আছে,যে জন্য ওদের মনের শৈশব কোনোদিনই ঘুচতে চায় না।ঘুণ যদি ধরে তো একেবারে কাঁচা মনেই ধরে, নইলে ওরা আজন্ম শিশু।জীবন-সাগরের তীরে বালি খুঁড়ে পুকুর তৈরি করে ওরা খুশি থাকবে,সমুদ্রের সঙ্গে তাদের সে কীর্তির তুলনা কখনো করে না।ডাবের জলে ডাবের শাঁসে জগতের ক্ষুধা তৃষ্ণা দূর হয় চিরদিন এই থাকত ওদের ধারণা,জগতের ক্ষুধাও ওরা বুঝবে না,তৃষ্ণার প্রকৃতিও জানবে না।
৪৭#
বিয়ের ব্যাপারে বাধ্য হয়ে মানুষকে যে সব হিসাব ধরতে হয় সেদিক থেকে ধরলে কোনো ছেলেমেয়েই সংসারে ঠকে না।
৪৮#
আর্থিক পরাধীনতা স্বীকার করবার সাহস যে মেয়ের নেই তাকে কেউ ভালবাসে না।
৪৯#
মৃত্যুর চেয়ে প্রিয়জনকে হারানো বেশি শোকাবহ।
৫০#
ভালবাসা মরে কখন?যখন ভালবাসার শক্তি থাকে না।যে ভালবাসতে পারে না,প্রেম না থাকলে তার কী এসে যায়?