মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ ও গণআন্দোলনের নায়ক, তিনি জনসাধারণের কাছে ‘মাওলানা ভাসানী’ নামেই অধিক জনপ্রিয়। মাওলানা ভাসানী তার জীবদ্দশায় ১৯৪৭-এ সৃষ্ট পাকিস্তান ও ১৯৭১-এ প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মাওলানা ভাসানী বাংলাদেশের দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের কাছে “মজলুম জননেতা” হিসাবে সমধিক পরিচিত।
মাওলানা ভাসানী ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট গঠনকারী প্রধান নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায়ও তিনি বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিনি মাওপন্থী কম্যুনিস্ট তথা বামধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। তার অনুসারীরা অনেকে এজন্য তাকে “লাল মওলানা” নামেও ডাকতেন। মাওলানা ভাসানী কৃষকদের জন্য পূর্ব পাকিস্তান কৃষক পার্টি করার জন্য সারাদেশব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
নেতা হিসেবে মাওলানা ভাসানী ছিলেন দূরদর্শী নেতা। ভাসানী ৫০ এর দশকেই নিশ্চিত হয়েছিলেন যে, পাকিস্তানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ একটি অচল রাষ্ট্রকাঠামো। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাও মাওলানা ভাসানী। সুপ্রিয় পাঠক আজকের এই ব্লগে মাওলানা ভাসানীর কিছু বিখ্যাত রাজনৈতিক উক্তি এই ব্লগে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করছি মাওলানা ভাসানীর সবগুলো উক্তিই আপনাদের ভালো লাগবে।
১#
আজ দেখতে পাচ্ছি স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করছে লুটপাট সমিতি। একমাত্র কৃষক-শ্রমিক শ্রেনীই তা সমূলে ধ্বংস করতে পারেন। তাই আমি বলছি, আপনাদের জাতীয় শত্রু বিতাড়িত হলেও শ্রেনী শত্রু খতম হয়েছে বলে তা মনে করবেন না।
২#
ইসলাম সকল মানুষকে,সে মুসলমান হউক বা না হউক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দান করিয়াছে।
৩#
নীল নদের পানি যেমন নীল নয়, তেমনি জামায়াতে ইসলাম মানেই ইসলাম নয়।
৪#
ব্যক্তির চেয়ে আদর্শ ঊর্ধ্বে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতিতে যাহারা বিশ্বাসী, তাহারা আর যাহাই হউন, প্রকৃত দেশপ্রেমিকের মর্যাদা লাভ করিতে পারেন না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি জনতার আশা-আকাংক্ষার পরিপন্থী। ব্যক্তির দোষে গোটা জাতিই ক্ষতিগ্রস্থ হইতে বাধ্য। এই কারণেই আমি নেতা মানি প্রতিষ্ঠানের কর্মসূচীকে।
৫#
ধর্মের সঙ্গে ভাষার কোন সম্পর্ক নাই। ধর্ম এক জিনিস আর ভাষা আর একটি জিনিস। একটির সঙ্গে অন্যটিকে যারা মেশায় তারা অসৎ ও মতলববাজ। উর্দুর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কী? আরব দেশের মানুষ উর্দুতে কথা বলে নাকি? ইরানের মানুষ কি উর্দু জানে? উর্দু কি দুনিয়ার সব মুসলমানের ভাষা? বাংলাকে যারা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা চায় তারা পাকিস্তানের দুশমন নয়। যারা চায় না তারাই পাকিস্তানের দুশমন। পাকিস্তানের যদি ক্ষতি হয় তাহলে বাংলা-বিরোধীদের দ্বারাই হবে।
৬#
আমাদের ভাগ্য আমাদেরই গড়ে নিতে হবে। পিন্ডির গোলামি ছিন্ন করতে হবে।
৭#
গড়িতে হইলে আগে ভাঙিতে হয়। মানুষের মুক্তি আপোষরফায় আসে না। সুদূরপ্রসারী, কর্মসূচীভিত্তিক বিপ্লবই এর একমাত্র পাথেয়।
৮#
যেসব মুসলমান হিন্দুদের বিধর্মী মনে করে, তাদের ক্ষতি করতে চায়, আমি তাদের বলি তোমরা কারা? খুব বেশি হইলে চার-পাঁচ পুরুষ আগে তোমরা কারা ছিলা? তোমাদের বাপ-দাদার বাপ-দাদারা ছিলেন হয় হিন্দু নয় নমঃশূদ্র। এ দেশের হিন্দু আর মুসলমানের একই রক্ত। কতজন আরব ইরান-আফগানিস্তান হইতে আসিয়াছে? পাঁচ পুরুষ আগে যারা ছিলো তোমাদের পূর্বপুরুষ আজ তাদের গায়ে হাত তুলতে তোমাদের বুক কাঁপে না? তোমরা কি মানুষ না পশু?
৯#
আমার নেতা কোন ব্যক্তি বিশেষ নয় । আমার নেতা দেশের জনতা । দেশের অধিবাসী । আপামর জনসাধারণ ।
১০#
নিজেকে জয় কর; জগৎ তোমার পদানত হইবে । দুনিয়ার পিছনে ঘুরিও না । দুনিয়াই তোমার পশ্চাতে ঘুরিবে ।
১১#
শুনো, ধর্ম আর দেশ মিলাইতে যায়ো না। পরে ফুলের নাম কী দিবা, ফাতেমা-চূড়া?
১২#
রাজনীতি শিখিতে হয় সাধারণ মানুষ আর পরিবেশ হইতে।
১৩#
এই পার্থিব জীবনে খাওয়া পরার সংস্থানের পরও মানুষের অপর একটি চাহিদা থাকিয়া যায়। তাহা হইলো আধ্যাত্মিক উপলব্ধি। উহা সংসার জীবনের সুখ-দুঃখ, ভালবাসা, সৃষ্টি জগতের রহস্য, সামাজিক পারিবারিক বন্ধন ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিরাজ করিতেছে।
১৪#
হিন্দুর ক্ষুধা, মুসলমানের ক্ষুধা, বৌদ্ধের ক্ষুধা, খ্রিষ্টানের ক্ষুধা একই রকম। শোষক ও জালেমের কোনো ধর্ম নেই। মজলুমের কোনো ধর্ম নেই। জালেম হিন্দু হোক আর মুসলমান হোক, দেশি হোক আর বিদেশি হোক, কালো চামড়ার হোক আর সাদা চামড়ার হোক-সব সমান।
১৫#
এভাবেই যদি পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর শাসন-শোষণ চলতে থাকে, তবে আগামী ১০ বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি আসসালামু আলাইকুম জানাবে। তোমাদের পথ তোমরা দেখো, আমাদের পথ আমরা দেখব।
১৬#
যাহোক আমি ইতিহাসবেত্তা নই, রাজনৈতিক আন্দোলনের ভাষ্যকারও নই। আমি হাড়ে হাড়ে রাজনীতিবিদ থাকতে চাই এবং অহিংসার বানী নয় বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্দীপিত হইয়া আন্দোলন চালাইয়া যাইতে চাই।
১৭#
আমি খেটে খাওয়া মানুষের কথা বলি।
১৮#
ধর্মীয় শিক্ষার নামে জীবনের সাথে সম্পর্করহিত তথাকথিত মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তন করিয়া সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় সুকৌশলে আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মানো হইয়াছে।
১৯#
আমি দেখিতে পাইতেছি নানা মতবাদ নানা পন্থা মানুষকে নতুন নতুন শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়া ফেলিয়াছে। শ্রেণীহীন সমাজের কথা ভাবিতে গিয়া মানুষ আত্মকেন্দ্রিক ও হিংস্র হইয়া পড়িয়াছে। আমার বিশ্বাস একমাত্র রবুবিয়াতের দর্শনই জাতি,ধর্ম মতবাদ নির্বিশেষে শান্তি দিতে পারে। সবার লক্ষ্য যদি স্রষ্টা হয়, সকল সমস্যার সমাধানকল্পে যদি স্রষ্টার নিয়ম প্রবর্তিত হয় তবে হানাহানির অবকাশ কোথায়? স্রষ্টার নিকট তো সবাই সমান। তিনি একই বিধানে সকলের নিকট দাতা,দয়াময়,প্রেরণাদানকারী এক কথায় সকল চেতনার উৎস।
২০#
আসাম আমার, পশ্চিমবঙ্গ আমার ত্রিপুরাও আমার। এগুলো ভারতের কবল থেকে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মানচিত্র পূর্ণতা পাবেনা।
২১#
বড় বড় বই পড়িয়া অনেক তত্ত্বকথা কথা জানা যায়,অনেক ফরমুলা, থিওরী ইত্যাদির সহিত পরিচিত হওয়া যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের নাড়ি বুঝিতে হইলে শুধু বই পড়িয়া রাজনীতি করিলেই চলিবে না তাহাদের সহিত একাত্ম হইয়া যাইতে হইবে।
২২#
পিন্ডির গোলামির জিঞ্জির ছিন্ন করেছি দিল্লির দাসত্ব করার জন্যে নয়।
২৩#
আমদের সংগ্রাম দুই মুখী হইতে হইবে । একটি প্রত্যক্ষ আর একটি পরোক্ষ । প্রত্যক্ষটিতে থাকিবে বিদ্রোহ, পরোক্ষটিতে থাকিবে শোধন । দুই দিকই যদি একতালে চালাইয়া যাইতে পারি, তবেই আমরা ইস্পিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিব ।