তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (২৩ জুলাই, ১৮৯৮−সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৭১) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর এক বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক। তিনি ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি ছোটোগল্প-সংকলন, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ-সংকলন, ৪টি স্মৃতিকথা, ২টি ভ্রমণকাহিনি, একটি কাব্যগ্রন্থ এবং একটি প্রহসন রচনা করেন। আরোগ্য নিকেতন উপন্যাসের জন্য তারাশঙ্কর ১৯৫৫ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার ও ১৯৫৬ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং ১৯৬৭ সালে গণদেবতা উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া ১৯৬২ সালে তিনি পদ্মশ্রী এবং ১৯৬৮ সালে পদ্মভূষণ সম্মান অর্জন করেন।
তারাশঙ্করের উপন্যাস ও ছোটোগল্প অবলম্বনে বাংলা ভাষায় একাধিক জনপ্রিয় ও সমালোচকেদের দ্বারা প্রশংসিত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেগুলির মধ্যে সত্যজিৎ রায় পরিচালিত জলসাঘর ও অভিযান, অজয় কর পরিচালিত সপ্তপদী, তরুণ মজুমদার পরিচালিত গণদেবতা, তপন সিংহ পরিচালিত হাঁসুলী বাঁকের উপকথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১#
“নিজের পূণ্যের কথা বললে সে পূণ্য ক্ষয় হয়, কীর্তির কথা বললে সে কীর্তির বুনিয়াদে ফাটল ধরে, নিজের বেদনার কথা বললে নিজের আপমান করা হয়; নিজের সুখের কথা বললে অহংকারের পাপ স্পর্শ করে”
(আমার কালের কথা ~ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়)
২#
“আমি হেরেছি হেরেছি সত্য এ বচন।
হেরেই কিন্তু হয় সার্থক জীবন।”
(কবি ~ তারাশঙ্কর বন্দ্যােপাধ্যায়)
৩#
চণ্ডালের ঘরের টাকা বামুনের হাতে এলেই শুদ্ধ হয়ে যায় ।
৪#
নিতাইয়ের বুক-ভরা দীর্ঘ নিঃশ্বাস এতক্ষণে ঝরিয়া পড়িল। যে কথাটা বলা হইল না সেই কথা গান হইয়া বাহির হইয়া আসিল।
” বলতে তুমি বলো নাকো, (আমার) মনের কথা থাকুক মনে।
(তুমি) দূরে থাকো সুখে থাকো আমিই পুড়ি মন – আগুনে।”
(কবি ~ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়)
৫#
“ভালোবেসে মিটলো না সাধ্,
ভরলো না মন এই জীবনে।
হায়, জীবন এতো ছোট কেনো?”
―তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
৬#
মেয়েদের মা সাজিবার শক্তি সহজাত।
৭#
পরের দূঃখের জন্যে যে কাঁদতে পারে, সে মহৎ; কিন্তু অকারণ অপরাধের দায়ে নিজেকে দায়ী করে পীড়ন করার নাম দুর্বলতা।
৮#
বিচার নিষ্ঠুর নয়, সে সাংসারিক সুখদুঃখের গণ্ডির উর্ধ্বে। জাস্টিস ইজ ডিভাইন।
৯#
পেটেই তোদের আগুন লেগেছে রে, পেট আর কিছুতেই ভরছে না!
১০#
সুখের মধ্যে মানুষকে চিনতে পারা যায় না, বিলু! দুঃখের দিনেই মানুষকে ঠিক বোঝা যায়। আগে মনে হত এমন স্বার্থপর নীচ গ্রাম আর নাই!
১১#
যাইবার সময় সে বলিয়া গিয়াছে- খোকার ভার তোমার উপর রহিল, আরও রহিল ঘর-দুয়ারি-মরাই-গরি-বাছুর-ধান-জমি-সবের ভার। তুমি আমার ঘরের লক্ষ্মী, তুমি চঞ্চল হইলে চলিবে না। সর্ব-অবস্থায় অচলা হইয়া থাকতে হবে।
১২#
মরিলেও নাকি মানুষের স্বভাব যায় না।
১৩#
কাঁদিলে তাহার বুকের ভিতরে গভীর যন্ত্রনাদায়ক আবেগটা কমিয়া যায়। কাঁদিতে কাঁদিতে সে কিছুক্ষণ পর তৃপ্তি অনুভব করে, তাহার পর একটা আনন্দ পায়।
১৪#
মানুষকে ডেথ সেন্টেন্স দেওয়ার চেয়ে যন্ত্রনাদায়ক কর্তব্য কিছু হয় না।
১৫#
মানুষের মধ্যেই জীবনশক্তির শ্রেষ্ঠ প্রকাশ । জড়ের মধ্যে যে – শক্তি অন্ধ দুর্বার , জন্তুর মধ্যে যে – শক্তি প্রবৃত্তির আবেগেই পরিচালিত , মানুষের মধ্যে সেই শক্তি মন বুদ্ধি ও হৃদয়ের অধিকারী হয়েছে । জন্তুর প্রকৃতির পরিবর্তন হয় না ; সার্কাসের জানোয়ারকে অনেক শাসন করে অনেক মাদক খাইয়েও তার সামনে চাবুক এবং বন্দুক উদ্যত রাখতে হয় । একমাত্র মানুষেরই পরিবর্তন আছে , তার প্রকৃতি পাল্টায় । ঘাত প্রতিঘাতে , শিক্ষায় – দিক্ষায় , নানা কার্যকারণে তার প্রকৃতির শুধু পরিবর্তনই হয় না , সেই পরিবর্তনের মধ্যে সে মহত্তর প্রকাশে প্রকাশিত করতে চায় নিজেকে , এইটেই অধিকাংশ ক্ষেত্রের নিয়ম । অবশ্য বিপরীত দিকের গতিও দেখা যায় , কিন্তু সে দেখা যায় স্বল্পক্ষেত্রে ।
১৬#
স্থূল প্রমাণ প্রয়োগ যেখানে একমাত্র অবলম্বন, মানুষ যতক্ষণ স্বার্থান্ধতায় মিথ্যা বলতে দ্বিধা করেন না, ততক্ষণ ডিভাইন জাস্টিস বোধ হয় অসম্ভব। সরল সহজ সভ্যতাবঞ্চিত মানুষ মিথ্যা বললে সে মিথ্যাকে চেনা যায়, কিন্তু সভ্য – শিক্ষিত মানুষ যখন মিথ্যা বলে তখন সে – মিথ্যা সত্যের চেয়ে প্রখর হয়ে উঠে। পারার প্রলেপ লাগানো কাচ যখন দর্পণ হয়ে ওঠে তখন তাতে প্রতিবিম্বিত সূর্যচ্ছটা চোখের দৃষ্টিকে সূর্যের মতই বর্ণান্ধ করে দেয়। জজ, জুরী, সকলকেই প্রতারিত হতে হয়। অসহায়ের মতো।
১৭#
মৃত্যুযন্ত্রণার মধ্যেও তৃষ্ণার্ত মানুষ নিজের মুখের সামনে তুলে ধরা জলের পাত্র অন্য তৃষ্ণার্তের মুখে তুলে দিয়ে বলে , ‘ দাই নীড ইজ গ্রেটার দ্যান মাইন । লক্ষ লক্ষ এমনই ঘটনা ঘটেছে । নিত্য ঘটছে অহরহ ঘটছে । কিন্তু এ মহাসত্যকে কে অস্বীকার করবে যে , যে মরণোন্মুখ তৃষ্ণার্ত নিজের মুখের জল অন্যকে দিয়েছিল , তার তৃষ্ণার যন্ত্রণা আর অবধি ছিল না ।
১৮#
আত্মরক্ষা যেমন সহজ প্রবৃত্তি, সাধারণ ধর্ম-তেমনি আত্মত্যাগ, পরার্থে আত্ম বিসর্জনও মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, মহত্তর ধর্ম”
“মা যদি সন্তানকে হত্যা করে নিজের প্রাণের জন্য, পিতা যদি পুত্র হত্যা করে নিজের প্রাণের জন্য, বড় ভাই যদি অসহায় দুর্বল ছোট ভাইকে হত্যা করে নিজের প্রাণ রক্ষা করে মহত্তর মানবধর্ম বিসর্জন দেয়, সবল যদি দুর্বলকে রক্ষা না করে, তবে এই মানুষের সমাজ আর পশুর সমাজে প্রভেদ কোথায়?
১৯#
জমিদার আর প্রজা – বাপ আর বেটা । বেটার কসুর হলে বাপ শাসন করে , যুগি বেটা হলে — তার গোসা হয় । বাপ আবার পেয়ার করলি পরেই – সে গোসা ছুটে যায় ।
২০#
কোন্ ঘাটেতে লাগায়েছ ‘লা’ও আমার ভাঁজো সখি হে!
আমি তোমায় দেখতে পেছি না।
তাই তো তোমায় খুঁজতে এলাম হাঁসুলীরই বাঁকে—
বাঁশবনে কাশবনে লুকাল্ছ কোন ফাঁকে!
ইশারাতে দাও হে সখি সাড়া
তোমার আ-ঙা পায়ে লুটিয়ে পড়ি গা
ও আমার ভাঁজো সখি হে!
২১#
এত কাছে হইতে এমন করিয়া একা বসিয়া দু’চোখ ভরিয়া নিতাই জীবনের ওপারকে কখনও দেখে নাই । জীবনের ওপারে মৃত্যুপুরী, মরণ ওখানে বসিয়া আছে ।
২২#
চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে ব’লে কে দেখে না চাঁদ?
তার চেয়ে চোখ যাওয়াই ভাল ঘুচুক আমার দেখার সাধ।
২৩#
অবাধ্য মন লজ্জা পায় না, দুঃখিত হয় না।
২৪#
কৌশলে স্বার্থসিদ্ধি হয়, কার্যোদ্ধার হয় ― কিন্তু সত্যের প্রতিষ্ঠা হয় না। কৌশলের জন্মদাত্রী বুদ্ধি ― তারই মধ্যে কোথায় যেন অদৃশ্যভাবে অবস্থান করছে ― মিথ্যা। জীবনে যুদ্ধে হোক, সন্ধিতে হোক, বন্ধুত্বে হোক, যেখানে বুদ্ধিকে সর্বস্ব করবে, সেইখানেই মিথ্যা এসে রন্ধ্রপথে শনির মত প্রবেশ করবে। কৌশলে সত্যরক্ষার অধিকার কারও নেই।
২৫#
সংসারে যে সহ্য করে সেই মহাশয়।
ক্ষমার সমান ধর্ম কোন ধর্ম নয়॥
২৬#
জীবনে যত মানুষ দেখলাম—মানুষই দেখেছি আমি, মানুষ খুঁজে বেড়িয়েছি, দেখেছি প্রতিটি মানুষের মধ্যেই কখনো-না-কখনো এমনি এক-একটি বা এমনি কয়েকটি বিচিত্র বিকাশ হয়, যা মনে করিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয় তারও মধ্যে আছে সুন্দর বা মধুরের একটি প্রবাহ; সে শুধুই বালুচর নয়, হঠাৎ একদিন বালুচর ভেদ করে উৎসারিত হয় মধুরের একটি নির্ঝর। প্রতিটি- প্রতিটি মানুষের মধ্যেই হয়।
২৭#
মরণ তোমার হার হল যে মনের কাছে
ভাবলে যারে কেড়ে নিলে সে যে দেখি মনেই আছে
মনের মাঝেই বসে আছে।
আমার মনের ভালবাসার কদমতলা-
চার যুগেতেই বাজায় সেথা বংশী আমার বংশীওলা।
বিরহের কোথায় পালা-
কিসের জ্বালা?
চিকন-কালা দিবস নিশি রাধায় যাচে।
২৮#
এ ভুবনে ডুবল যে চাঁদ সে ভুবনে উঠল কি তা?
হেথায় সাঁঝে ঝরল যে ফুল হোথায় প্রাতে ফুটল কি তা?
এ জীবনের কান্না যত― হয় কি হাসি সে ভুবনে?
হায়! জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?
২৯#
কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?
কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?
৩০#
‘আমার মায়ের একবিন্দু চোখের জল পৃথিবী ডুবিয়ে দিতে পারে মহাশয়।’
//আরোগ্য নিকেতন – তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
৩১#
“মহাপুরুষের স্পর্শ মহাপুরুষের সঙ্গেই চলে যায়।
অন্তত বস্তুজগতে থাকে না। বস্তুজগতের ধরে রাখবার শক্তিনেই, থাকলে মিশরের ফারাওদের মমিদের কল্যাণেই পুরনো মিশর বেঁচে থাকত। বুদ্ধের অস্থির উপর স্তূপের কল্যাণে ভারতবর্ষের সকল দুঃখ দূরে যেত। ঈশ্বরের পুত্রের আবির্ভাবের পর প্রতিবেশীতে
প্রতিবেশীতে মিলে ইয়োরোপ জুড়ে এক অপরুপ প্রেমের রাজ্য গড়ে উঠত।বএমনভাবে ইয়োরোপই বিশ্বযুদ্ধের কেন্দ্র হয়ে উঠত না।”
সপ্তপদী (তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়)
৩২#
❝ মৃত্যু সংসারে ধ্রুব।যে জন্মায় তার মৃত্যু হবেই।মৃত্যুর বহু পথ,সে অনিবার্য।কেউ রোগে মরে, কেউ আঘাতে মরে,কেউ ইচ্ছে করে মরে,আত্মহত্যা করে।তবে রোগই হল মৃত্যুর সিংহদ্বারের পাকা সড়ক।রোগমাত্রেই মৃত্যুর স্পর্শ বহন করে; সব রোগে মানুষ মরে না কিন্তু খানিকটা এগিয়ে দেয়; জীবনীশক্তি ক্ষয় করে ঠেলে দেয় খানিকটা।চিকিৎসক চিকিৎসা করে,তার জ্ঞানমত যে বাঁচবে বলে মনে হয় তাকে সে মরবে বলে না, যে মরবে বলে মনে হয় তার ক্ষেত্রে কেউ আকারে ইঙ্গিতে জানায়, বলে বড়ো ডাক্তার আনুন …❞
📖 আরোগ্য -নিকেতন
🖋️ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
৩৩#
এই খেদ মোর মনে
ভালবেসে মিটল না আশ- কুলাল না এ জীবনে।
হায়, জীবন এত ছোট কেনে?
এ ভুবনে?
~ কবি, তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়
৩৪#
অন্তরের শুভ আকাঙ্ক্ষা এবং উচ্চ কল্পনা থাকিলেই সংসারে তাহা পূর্ণ হয় না। পারিপার্শ্বিক অবস্থাটাই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় শক্তি।
৩৫#
পাথরকে দুঃখের কথা বলিয়া কি হইবে? অরণ্য-রোদনে ফল কি?
৩৬#
সেদিন একখানা ছেলেদের বইয়ে একটা ছড়া দেখিল- লেখাপড়া করে যেই, গাড়ী ঘোড়া চড়ে সেই। দেবু সেই লাইনটি বারবার কলম চালাইয়া কাটিয়া দিল। তারপর বোর্ডের উপর খড়ি দিয়া লিখিয়া দিল- লেখাপড়া করে যেই- মহামানী হয় সেই।
৩৭#
বাউল বল, দেবতা বল, সবার ভিতর দিয়ে তোমাকেই চেয়ে এসেছি এতোদিন।
৩৮#
স্থুল প্রমাণ-প্রয়োগের আবরণ ছিঁড়ে মর্ম – সত্যকে আবিষ্কার করে তেমনি বিচার করতে হবে যা অভ্রান্ত, যাকে বলতে পারি ডিভাইন জাস্টিস ।
৩৯#
সাপকে এড়িয়ে পথ চলা যায়, কিন্তু পাপকে এড়িয়ে পথ চলা যায় না।
৪০#
সুরমা এসে দাঁড়ালেন তার পাশে, শান্ত ক্লান্ত মুখখানি চারপাশে চুলগুলি এলিয়ে পড়েছে, দুচোখের কোণ থেকে নেমে এসেছে দুটি বিশীর্ণ জলধারা, নিরাভরণা-বেদনার্তা, পরনে একখানি সাদা শাড়ি; তপস্বিনীর মতো।
৪১#
সামাজিক ও মানবিক বিচার সর্বত্র একমত হতে পারে না বলেই আইন মানবিক বিচারে ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে একালে। যা সমাজের বিচারে পাপ সেই সূত্র অনুযায়ীই তা সর্বক্ষেত্রে আইনের বিচারের দণ্ডনীয় অপরাধ বলে স্বীকৃত নয় । যাকে তিনি বলেছেন দেহলালসা – আইনের বিচারে আমার দৃষ্টিতে তা সর্বজয়ী ভালবাসা প্যাশন অব লাইফ ; তার জন্য মর্মান্তিক মূল্য দিয়েও সে অনুতপ্ত নয় , লজ্জিত নয় ।